RSS

Category Archives:

কেয়াফুল

যতীন্দ্র মোহন বাগচী

ফুল চাই —– চাই কেয়াফুল  !——
        সহসা পথের ‘পরে
          আমার এ ভাঙ্গা ঘরে
               কন্ঠ কার ধ্বনিল আকুল |
               তখনো শ্রাবণ-সন্ধ্যা
                    নিঃশেষে হয়নি বন্ধ্যা—–
                           থেকে থেকে ঝরিতেছে জল ;
               পবন উঠিছে জেগে,
                     বিজলী ঝলিছে বেগে——
                            মেঘে মেঘে বাজিছে মাদল |
জনহীন ক্ষুব্ধ পথ
     জাগিছে দুঃস্বপ্নবৎ—-
            বুকে চাপি’ আর্ত্ত অন্ধকার ;
কোনমতে কাজ সারি’
      যে যার ফিরিছে বাড়ী,
            ঘরে ঘরে বন্ধ যত দ্বার|
               শূন্য ঘরে
        হিয়া গুমরিয়া মরে
               স্মরি’ যত জীবনের ভুল ;
অকস্মাৎ তারি মাঝে
      ধ্বনি কার কানে বাজে—–
             চাই ফুল—-চাই কেয়াফুল !
                  পাগল !   আজি এ রাতে
                        এ দুর্য্যোগ-অভিঘাতে—-
                             বৃষ্টিপাতে বিলুপ্ত মেদিনী ;
                   তার মাঝে কে আছে,
                        কেতকী-সৌরভ যাচে !
                                কোথায় বা হবে বিকিকিনি ?
পবন উঠিছে মাতি !
      কিছুক্ষণ কান পাতি’
           মনে হ’ল গিয়াছে বালাই ;
সহসা আমারি দ্বারে
     ডাক এল একেবারে—-
          চাই ফুল — কেয়াফুল চাই !
                ভাবিলাম মনে মনে—–
                       হয়ত বা এ জীবনে
                           কোনোদিন কিনেছিনু ফুল ;
                  সেই কথা মনে ক’রে
                       আজো বা আশায় ঘোরে ;
                              কিম্বা কারে করিয়াছে ভুল !
তাড়াতাড়ি আলো তুলি’
       বাহিরিনু দ্বার খুলি,
              সবিস্ময়ে দেখিলাম চেয়ে—-
মাথায় বৃহৎ ডালা,
      দাঁড়ায়ে পসারী-বালা—–
           শ্রাবণ ঝরিছে অঙ্গ বেয়ে ;
            কহিলাম, এ কি কান্ড !
                   তোমার পসরাভান্ড
                        আজ রাতে কে কিনিবে আর ?
            এ প্রলয়ে কারো কাছে
                   কিছু কি প্রত্যাশা আছে—–
                        কেন মিছে বহিছ এ ভার !
আর্দ্র দেহে আর্দ্র বাসে
       সে কহিল মৃদু হাসে,—–
            শিরে বায়ু সুগন্ধ ছড়ায়—-
যে ফুল বেসাতি করি,
     বাদল যে শিরে ধরি,—–
            কপালে লিখিল বিধি তাই !
                    বহিয়া দুখের ঋণ
                 যে কষ্টে কাটাই দিন—–
                           এ দুর্দ্দিন কিবা তার কাছে ?
             —— ওগো তুমি নেবে কিছু ?
                       নয়ন হইল নীচু—-
                             সেথাও বা মেঘ নামিয়াছে !
খোলা দরজার পাশে
      বায়ু গরজিয়া আসে,
           ফুলবাসে ভরি দেহ-মন ;
ঝর-ঝর  ঝরে জল,
     আঁখি করে ছল-ছল
          ঘনাইয়া প্রাণের শ্রাবণ !
                      বাদলের বিহ্বলতা—-
                        বুঝি হায় !   লাগিল তা’
                                নয়নে বচনে সর্ব্ব দেহে ;
                        সহসা চাহিয়া আড়
                         রমণী ফিরাল ঘাড়—–
                                উর্দ্ধে যেন কি দেখিবে চেয়ে !
না কহিয়া কোন বাণী
      পসরা লইনু টানি’—–
           মূল্য তার হাতে দিনু যবে,
উজার করিতে ডালা
      কাঁদিয়া ফেলিল  বালা——
            ওমা এ কি —- এত কেন হবে ?
                        কহিনু —যা’ কিনিলাম,
                               এ নহে তাহারি দাম—–
                                    প্রতিদিন দিতে হবে মোরে ;
                         এক পণ দুই পণ—-
                                  যেদিন যেমন মন,
                                          তাহারি আগাম দিনু তোরে ;
কতক বুঝে’  না-বুঝে’
       হৃদয়ের ভাষা খুঁজে’
              বহুকষ্টে জানাইয়া তাই,
পুষ্পগন্ধে মোরে ঘিরে’
       অন্ধকারে ধীরে-ধীরে
                পসারিনী লইল বিদায় |
                           ফিরিনু একলা ঘরে—–
                                বাদল তখনো ঝরে,
                                      পুষ্পগন্ধে পূর্ণ গৃহতল ;
                            শয্যা লইলাম পাতি’
                                নিবায়ে দিলাম বাতি—-
                                        আবার আসিল বেগে জল !
রুদ্ধ জানালার ফাঁকে
       বাতাস কাহারে ডাকে,
              বিজলী চমকি’ কারে চায় !
কোন্ অন্ধ অনুরাগে
        ত্রিযামা যামিনী জাগে
              শ্রাবণ ব্যাকুল-ব্যর্থতায় !
                                সঙ্গীহীন শূন্য ঘরে
                                        হিয়া গুমরিয়া মরে—-
                                                 স্মরিয়া এ জীবনের ভুল ;
                                 সেই সাথে থেকে- থেকে
                                        মনে হয় — গেল ডেকে’
                                                কাননের যত কেয়াফুল !
 

কলঙ্ক

যতীন্দ্র মোহন বাগচী

বাতাবিকুঞ্জে সন্ধ্যার বায় পুষ্পপরাগচোর——
কলঙ্কী মন, চেয়ে দেখ্ আজি সঙ্গী মিলেছে তোর |
          দিবা অবসান, রবি হ’ল রাঙা,
          পশ্চিমাকাশে নট্ কনা -ভাঙা ;
সঙ্গহীনের যাহা কিছু কাজ সাঙ্গ করেছি মোর,
কুঞ্জদুয়ারে ব’সে আছি একা কুসুমগন্ধে ভোর !

আধফুটন্ত বাতাবিকুসুমে কানন ভরিয়া আছে,—-
কি গোপন কথা গুঞ্জরি’ অলি ফিরিছে ফুলের কাছে !
          ফুটনোন্মুখ ফুলদলগুলি
          পুলক-পরশে উঠে দুলিদুলি
গন্ধভিখারী সন্ধ্যার বায় ফুলপরিমল যাচে—–
সঙ্কোচে নত পুষ্পবালিকা—অতিথি ফিরে বা পাছে !

বেলা বয়ে যায়, সন্ধ্যার বায় আসি’ কহে বার বার,
সন্ধ্যা হয় যে অন্ধ কুসুম—–খোলো অন্তর-দ্বার !
          মুকুলগন্ধ অন্ধ ব্যথায়
          কুঁড়ির বন্ধ টুটিবারে চায়,
লুটাইতে চায় সন্ধ্যার পায় রুদ্ধ আবেগভার,
বিকাইতে চায় চরণের পরে কৌমার সুকুমার |

মন্থরপদে সন্ধ্যা নামিছে কাজলতিমিরে আঁকা,
দুয়ারে অতিথি, অন্তরে ব্যথা— সম্ভব সে কি থাকা ?
          গন্ধে পাগল অন্তর যার,
          আবরণ মাঝে থাকে সে কি আর,
খুলি’ দিল দ্বার, পরান তাহার পরাগে-শিশিরে মাখা ;
কুঞ্জ ঘিরিয়া আঁধারে ছাইল স্বপ্নপাখীর পাখা |

বাতাবিকুঞ্জে সন্ধ্যার বায় পুষ্পপরাগচোর—-
হা রে কলঙ্কী হৃদয় আমার, সঙ্গী মিলেছে তোর |
          দূরদিগন্তে দিবা হল সারা ;
          অন্তর ভরি ফুটে’ উঠে তারা,
নব-ফুটন্ত নেবুর গন্ধে আসিল তন্দ্রাঘোর—–
কলঙ্কী প্রেম, মুগ্ধ হৃদয়—–একই পরিণাম তোর ||

 

কর্ম

যতীন্দ্র মোহন বাগচী

শক্তি মায়ের ভৃত্য মোরা- নিত্য খাটি নিত্য খাই,
শক্ত বাহু, শক্ত চরণ, চিত্তে সাহস সর্বদাই |
ক্ষুদ্র হউক, তুচ্ছ হউক, সর্ব সরম-শঙ্কাহীন—
কর্ম মোদের ধর্ম বলি কর্ম করি রাত্রি দিন |

চৌদ্দ পুরুষ নিঃস্ব মোদের – বিন্দু তাহে লজ্জা নাই,
কর্ম মোদের রক্ষা করে অর্ঘ্য সঁপি কর্মে তাই |
সাধ্য যেমন – শক্তি যেমন – তেমনি অটল চেষ্টাতে–
দুঃখে-সুখে হাস্যমুখে কর্ম করি নিষ্ঠাতে |

কর্মে ক্ষুধার অন্ন যোগায়, কর্মে দেহে স্বাস্থ্য পাই ;
দুর্ভাবনায় শান্তি আনে — নির্ভাবনায় নিদ্রা যাই |

তুচ্ছ পরচর্চাগ্লানি— মন্দ ভালো— কোন্ টা কে—
নিন্দা হতে মুক্তি দিয়া হাল্কা রেখে মনটাকে |

পৃথ্বি-মাতার পুত্র মোরা, মৃত্তিকা তার শয্যা তাই ;
পুষ্পে-তৃণে বাসটি ছাওয়া, দীপ্তি-হাওয়া ভগ্নী-ভাই |
তৃপ্তি তাঁরি শস্যে-জলে ক্ষুত্ পিপাসা দুঃসহ |
মুক্ত মাঠে যুক্ত করে বন্দি তাঁরেই প্রত্যহ |

ক্ষুদ্র নহি – তুচ্ছ নহি – ব্যর্থ মোরা নই কভু |
অর্থ মোদের দাস্য করে – অর্থ মোদের নয় প্রভু |
স্বর্ণ বল, রৌপ্য বল, বিত্তে করি জন্মদান,
চিত্ত তবু রিক্ত মোদের নিত্য রহে শক্তিমান |

কীর্তি মোদের মৃত্তিকাতে প্রত্যহ রয় মুদ্রিত,
শুণ্য’ পরে নিত্য হের স্তোত্র মোদের উদ্গীত |
সিন্ধুবারি পণ্য বহি’ ধন্য করে তৃপ্তিতে,
বহ্নি’ মোদের রুদ্র প্রতাপ ব্যক্ত করে দীপ্তিতে |

বিশ্ব জুড়ি’ সৃষ্টি মোদের, হস্ত মোদের বিশ্বময়,
কাণ্ড মোদের, সর্বঘটে – কোন্ খানে তা দৃষ্য নয়?
বিশ্বনাথের যজ্ঞশালে কর্মযোগের অন্ত নাই,
কর্ম সে যে ধর্ম মোদের, — কর্ম চাহি — কর্ম চাই |

 

কখনো আমি

হুমায়ুন আজাদ

কখনো আমি স্বপ্ন দেখি যদি
স্বপ্ন দেখবো একটি বিশাল নদী।
নদীর ওপর আকাশ ঘন নীল
নীলের ভেতর উড়ছে গাঙচিল।
আকাশ ছুঁয়ে উঠছে কেবল ঢেউ
আমি ছাড়া চারদিকে নেই কেউ।

কখনো আমি কাউকে যদি ডাকি
ডাকবো একটি কোমল সুদূর পাখি।
পাখির ডানায় আঁকা বনের ছবি
চোখের তারায় জ্বলে ভোরের রবি।
আকাশ কাঁপে পাখির গলার সুরে
বৃষ্টি নামে সব পৃথিবী জুড়ে।

 

কে তুমি

কায়কোবাদ

( ১ )
কে তুমি? — কে তুমি?
ওগো প্রাণময়ী,
কে তুমি রমণী-মণি!
তুমি কি আমার, হৃদি-পুষ্প-হার
প্রেমের অমিয় খনি!
কে তুমি রমণী-মণি?

( ২ )
কে তুমি?—
তুমি কি চম্পক-কলি?
গোলাপ মতি
তুমি কি মল্লিকা যুথী ফুল্ল কুমুদিনী?
সৌন্দর্যের সুধাসিন্ধু,
শরতের পূর্ণ ইন্দু
আঁধার জীবন মাঝে পূর্ণিমা রজনী!
কে তুমি রমণী-মণি?

( ৩ )
কে তুমি? —
তুমি কি সন্ধ্যার তারা, সুধাংশু সুধা-ধারা
পারিজাত পুষ্পকলি
বিশ্ব বিমোহিনী
অথবা শিশির স্নাতা, অর্ধস্ফুট, অনাঘ্রাতা
প্রণয়-পীযূষ ভরা,সোনার নলিনী!
কে তুমি রমণী-মণি?

( ৪ )
কে তুমি?—
তুমি কি বসন্ত-বালা, অথবা প্রেমের ডালা,
প্রাণের নিভৃত কুঞ্জে
সুধা-নির্ঝরিনী!
অথবা প্রেমাশ্রু-ধারা, শোকে দুঃখে আত্মহারা
প্রেমের অতীত স্মৃতি,
বিধবা রমণী!
কে তুমি রমণী-মণি?

( ৫ )
কে তুমি?—
তুমি কি আমার সেই
হৃদয়-মোহিনী?
সেই যদি,—কেন দূরে? এস, এই হৃদি-পুরে
এস’ প্রিয়ে প্রাণময়ী,
এস’ সুহাসিনী!
এস’ যাই সেই দেশে,—ফুল ফুটে চাঁদ হাসে
দয়েলা কোয়েলা গায়
প্রাণের রাগিণী!
জরা নাই—মৃত্যু নাই, প্রণয়ে কলঙ্ক নাই
চল যাই সেই দেশে
এস’ সোহাগিনী!
কে তুমি রমণী-মণি?

 

কালের কলস

আল মাহমুদ

অনিচ্ছায় কতকাল মেলে রাখি দৃশ্যপায়ী তৃষ্ণার লোচন
ক্লান্ত হয়ে আসে সব, নিসর্গও ঝরে যায় বহুদূর অতল আঁধারে
আর কী থাকলো তবে হে নীলিমা, হে অবগুণ্ঠন
আমার কাফন আমি চাদরের মতো পরে কতদিন আন্দোলিত হবো
কতকাল কতযুগ ধরে
দেখবো, দেখার ভারে বৃষের স্কন্ধের মতো নুয়ে আসে রাত্রির আকাশ?
কে ধারালো বর্শা হেনে অসংখ্য ক্ষতের সৃষ্টি করে সেই কৃষ্ণকায়
ষাঁড়ের শরীরে
আর সে আঘাত থেকে কী-যে ঝরে পড়ে ঠিক এখনো বুঝি না
একি রক্ত, মেদ, অগ্নি কিম্বা শ্বেত আলো ঝরে যায়
অবিরাম অহোরাত্র প্রাণ আর কিমাকার ভূগোলে কেবলই–
ঝরে যায় ঝরে যেতে থাকে।

ক্রমে তাও শেষ হলে সে বন্য বৃষভ যেন গলে যায় নিসর্গশোভায়।
তুমি কি সোনার কুম্ভ ঠেলে দিয়ে দৃশ্যের আড়ালে দাঁড়াও
হে নীলিমা, হে অবগুণ্ঠন?
আকাশে উবুড় হয়ে ভেসে যেতে থাকে এক আলোর কলস
অথচ দেখে না কেউ, ভাবে না কনককুম্ভ পান করে কালের জঠর;
ভাবে না, কারণ তারা প্রতিটি প্রভাতে দেখে ভেসে ওঠে আরেক আধার
ছলকায়, ভেসে যায়, অবিশ্রাম ভেসে যেতে থাকে।

কেমন নিবদ্ধ হয়ে থাকে তারা মৃত্তিকা, সন্তান আর শস্যের ওপরে
পুরুষের কটিবন্ধ ধরে থাকে কত কোটি ভয়ার্ত যুবতী
ঢাউস উদরে তারা কেবলই কি পেতে চায় অনির্বাণ জন্মের আঘাত।
মাংসের খোড়ল থেকে একে একে উড়ে আসে আত্মার চড়ুই
সমস্ত ভূগোল দ্যাখো কী বিপন্ন শব্দে ভরে যায়
ভরে যায়, পূর্ণ হতে থাকে।

এ বিষণ্ণ বর্ণনায় আমি কি অন্তত একটি পংক্তিও হবো না
হে নীলিমা, হে অবগুণ্ঠন?
লোকালয় থেকে দূরে, ধোঁয়া অগ্নি মশলার গন্ধ থেকে দূরে
এই দলকলসের ঝোপে আমার কাফন পরে আমি কতকাল
কাত হয়ে শুয়ে থেকে দেখে যাবো সোনার কলস আর বৃষের বিবাদ?

 
এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

Posted by চালু করুন জানুয়ারি 19, 2012 in , কালের কলস

 

কী উৎফুল্ল আশা নিয়ে

বিনয় মজুমদার

কী উৎফুল্ল আশা নিয়ে সকালে জেগেছি সবিনয়ে।
কৌটার মাংসের মতো সুরক্ষিত তোমার প্রতিভা
উদ্ভাসিত করেছিল ভবিষ্যৎ, দিকচক্রবাল।
সময়ে ভেবেছিলাম সম্মিলিত চায়ের ভাবনা,
বায়ুসেবনের কথা, চিরন্তন শিখরের বায়ু।
দৃষ্টিবিভ্রমের মতো কাল্পনিক বলে মনে হয়
তোমাকে অস্তিত্বহীনা, অথবা হয়তো লুপ্ত, মৃত।
অথবা করেছে ত্যাগ, অবৈধ পুত্রের মতো, পথে।
জীবনের কথা ভাবি, ক্ষত সেরে গেলে পরে ত্বকে
পুনরায় কেশোদ্গম হবে না; বিমর্ষ ভাবনায়
রাত্রির মাছির মতো শান্ত হয়ে রয়েছে বেদনা-
হাসপাতালের থেকে ফেরার সময়কার মনে।
মাঝে মাঝে অগোচরে বালকের ঘুমের ভিতরে
প্রস্রাব করার মতো অস্থানে বেদনা ঝরে যাবে।

 

কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড

আব্দুল মান্নান সৈয়দ

এখানে কবিতা বানানো হয়।
সব ধরনের কবিতা।
রাজনীতিক কবিতা, সামাজিক কবিতা।
নাগরিক কবিতা, গ্রামীণ কবিতা।
প্রেমের কবিতা, শরীরের কবিতা।
স্বপ্নের কবিতা, বাস্তবের কবিতা।
চল্লিশের কবিতা, পঞ্চাশের কবিতা।
ষাটের কবিতা, সত্তরের কবিতা।
আশির কবিতাও আমরা বাজারে ছাড়ছি শিগগিরই।
কবিতার হাত, পা, মাথা, ধড়,
শিশ্ন, যোনি, চুল, নখ,
চোখ, মুখ, নাক, কান,
হাতের আঙুল, পায়ের আঙুল–
সব-কিছু মওজুদ আছে আমাদের এখানে।
স্বদেশি ও বিদেশি উপমা ও চিত্রকল্প,
শব্দ ও ছন্দ,
অন্ত্যমিল ও মধ্যমিল
লক্ষ লক্ষ জমা আছে আমাদের স্টকে।
ব্যাঙের ছাতার মতো আরো অনেক কবিতার কোম্পানি
গজিয়েছে বটে আজকাল। কিন্তু,
আপনি তো জানেনই,
আমাদের কোম্পানি ইতোমধ্যেই বেশ নাম করেছে।
আর ফাঁকি দিয়ে কি খ্যাতি অর্জন করা সম্ভব,
বলুন?
হ্যাঁ, আপনার অর্ডার-দেওয়া কবিতাটি এই-তো তৈরি হয়ে এলো।
চমৎকার হয়েছে।
ফিনিশিং টাচ শুধু বাকি।
একটু বসুন স্যার, চা খান,
কবিতার কয়েকটা ইস্ক্রুপ কম পড়ে গেছে আমাদের,
পাশের কারখানা থেকে একছুটে নিয়ে আসবার জন্যে
এখখুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি লতিফকে।

 

কবিতা বুঝিনি আমি

বিনয় মজুমদার

কবিতা বুঝিনি আমি ; অন্ধকারে একটি জোনাকি
যত্সামান্য আলো দেয়, নিরুত্তাপ, কোমল আলোক ।
এই অন্ধকারে এই দৃষ্টিগম্য আকাশের পারে
অধিক নীলাভ সেই প্রকৃত আকাশ প’ড়ে আছে—
এই বোধ সুগভীরে কখন আকৃষ্ট ক’রে নিয়ে
যুগ যুগ আমাদের অগ্রসর হয়ে যেতে বলে,
তারকা, জোনাকি—সব ; লম্বিত গভীর হয়ে গেলে
না-দেখা গহ্বর যেন অন্ধকার হৃদয় অবধি
পথ ক’রে দিতে পারে ; প্রচেষ্টায় প্রচেষ্টায় ; যেন
অমল আয়ত্তাধীন অবশেষে ক’রে দিতে পারে
অধরা জ্যোত্স্নাকে ; তাকে উদগ্রীব মুষ্টিতে ধ’রে নিয়ে
বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকাশের, অন্তরের সার পেতে পারি ।
এই অজ্ঞানতা এই কবিতায়, রক্তে মিশে আছে
মৃদু লবণের মতো, প্রশান্তির আহ্বানের মতো ।

 

কোনো মৃতার প্রতি

বুদ্ধদেব বসু

‘ভুলিবো না’ – এত বড় স্পর্ধিত শপথে
জীবন করে না ক্ষমা | তাই মিথ্যা অঙ্গিকার থাক |
তোমার চরম মুক্তি, হে ক্ষণিকা, অকল্পিত পথে
ব্যপ্ত হোক | তোমার মুখশ্রী-মায়া মিলাক, মিলাক
তৃণে-পত্রে, ঋতুরঙ্গে, জলে-স্থলে, আকাশের নীলে |
শুধু এই কথাটুকু হৃদয়ের নিভৃত আলোতে
জ্বেলে রাখি এই রাত্রে — তুমি ছিলে, তবু তুমি ছিলে |